১.
অতি নিম্নচাপে (মূত্রের বেগ) কাঁচা ঘুম ভেঙে গেল। এখন চেষ্টা করলেও ঘুম আসবে বলে মনে হয় না। মাঝরাতে একবার ঘুম ভাঙা মানে আমার আর ঘুমের আশা অর্থহীন। নিম্নচাপের কাজ সমাধান করে বিছানায় শুয়ে মোবাইলটা হাতে নিলাম। স্ক্রিনে চোখ যেতেই আঁতকে উঠলাম। নিতুর নম্বর থেকে একুশটা মিসড কল। রাত ১টা ৪৫ থেকে শুরু করেছে, এখন বাজে ২টা ১২। এতো রাতে ফোন করার মানে কি হতে পারে? বিপদ আপদ হলো নাতো বাসায়? মেসেঞ্জারে উঁকি দিতে গিয়ে দেখলাম নিতুর মেসেজে ফোন ভরে গেছে। সর্বশেষ মেসেজ, "শালার ব্যাটা মরার মতো ঘুমাইতেছিস নাকি!" উপরে কি মেসেজ আছে তা পড়ার ইচ্ছে নেই। অনিচ্ছা নিয়ে ফোন করলাম। সাথে সাথে কল রিসিভ করল। রিসিভ করেই মুখস্থ বিদ্যার মতো বলতে লাগল,
- তাড়াতাড়ি আমবাগানে চলে আয়। জলদি।
- কেন? এতো রাতে বাগানে কি করব?
- আরে ভাই বিয়ে করব পালিয়ে।
আচমকা কথাটা শুনে মনের লাল, নীল, সবুজ, হলুদ সব বাতি জ্বলতে লাগল। আহ! এতোদিন পর মেয়েটা না হয় বুঝল আড়াঁলে বসে আমিও কত পছন্দ করে গেছি তাকে। সারপ্রাইজটা এত রাতে না দিলেও পারত। কিন্তু পালিয়ে সরাসরি বিয়ে করাটা বাড়াবাড়ি। তবে শুভ কাজে দেরি কেন! হঠাৎ ওপাশ থেকে গাঢ় গলায় ভেসে উঠল,
- ছাগল কথা বলতেছিস না ক্যান?
ঘোর কেটে গিয়ে বললাম,
- আচ্ছা ১০ মিনিট। জামাকাপড় চেইঞ্জ করে আসি।
- কিছু করতে হবে না। যা পড়ে আছিস তা নিয়ে বেড়িয়ে পর। সময় নেই হাতে। আর আসার সময় তোর ভাঙাচোরা সাইকেলটাও নিয়ে আসিস। সময় নেই কিন্তু।
এই বলেই ওপাশ থেকে ফোন কেটে দিলো। আজ রাতটা যে এতো আনন্দের হবে কে জানতো? নিম্নচাপটা ধন্যবাদ দিলাম। তার জন্য ঘুমটা না ভাঙলে হয়ত এই আলাদীনের চেরাগ হাতে পাওয়ার মতন সংবাদ পেতাম না। যাক সাতপাঁচ না ভেবে বেড়িয়ে পড়া ভালো। আমার সাধের সাইকেলটা আর টর্চ নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম বাগানের দিকে।
২.
আমবাগানে এসেই খানিকটা ভড়কে গেলাম। নিতুর পাশে হাফ শার্ট পড়া একটা লোক দাঁড়িয়ে ছাগল দাড়ি চুলকাচ্ছে। কে আর হবে? হতে পারে মামাতো বা চাচাতো ভাই। পালাতে সাহায্য করতে এসেছে হয়ত। একবুক আশা আর হাসি নিয়ে এগিয়ে এলাম তাদের দিকে। সাইকেল থেকে নামতেই নিতু বলল,
- ফোন ধরতে এতো সময় লাগে কেন?
আমি বললাম,
- ফোন সাইলেন্ট করা ছিল।
নিতু আগ্রহের সঙ্গে বলল,
- শোন এ হলো মাহবুব। তোকে আগে বলি নাই। কারণ তুই বাড়াবাড়ি করবি। আজকে ওর সাথে পালিয়ে বিয়ে করব।
হঠাৎ যেন আকাশ ভেঙে পড়ল মাথায়। এর কোনো মানে হয়? জ্বলে ওঠা বাতিগুলো নিমিষেই চুপসে গেল। আমি বিরস মুখে ভদ্রতা রেখে লোকটার দিকে তাকিয়ে বললাম,
- আমি মাইনুদ্দিন। আপনার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগল।
মাহবুব নামক এই ব্যক্তি কিছু বলার আগেই নিতু ব্যস্ত হয়ে বলল,
- দেখা পরে আবার হবে। মাইনুদ্দিন শোন তোর সাইকেলটা লাগবে। এতো রাতে কোন যানবাহন দেখতে পাচ্ছি না। বিয়েটা হয়ে যাক তোকে সাইকেলটা দিয়ে দিব। কি দিবি?
শুধু শুধু কথা বাড়ানোর মতো অবস্থায় আমি নেই। তাই তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম,
- হ্যা হ্যা নিয়ে যা।
নিতু গলা নামিয়ে বলল,
- বাসার কেউ জানি আপাতত না জানতে পারে। আমিই পরে জানাব।
এইদিকে মাহবুব নামক লোকটি বলে উঠল,
- আমাদের তাড়াতাড়ি যাওয়া উচিত। এতক্ষণে হয়ত বাড়িতে জানাজানি হয়ে গেছে।
মনে মনে ব্যাটাকে হাজারো গালি দিতে থাকলাম। আহা! কি শখ দেখ বাবুর। অনিচ্ছা নিয়ে সাইকেলটা তার দিকে এগিয়ে দিলাম। হঠাৎ দূর থেকে চিল্লাচিল্লির আওয়াজ শুনা গেল। কেউ একজন বলে উঠলো, ঐ দেহেন নিতু আপার মতোন কাউরে জানি দেহান যায়। সঙ্গে সঙ্গে অন্যরা বলে উঠল, ঐ ধর ধর।
এদিকে মাহবুব বলে উঠল,
- খাইছেরে আমারে। নিতু দুঃখিত আমার জীবন আগে। গণপিটুনিতে মাইর খাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই।
নিতু অবাক হয়ে বলল,
- আরে আমি কই যাব?
মাহবুব বলে উঠল,
- তুমি জাহান্নামে যাও।
এই বলেই ব্যাটা আমার সাইকেল নিয়ে কেল্লা ফতে হয়ে গেল। আমি চোখ বড় করে বললাম,
- আরে আরে ওই আঁতেলের ঘরে আঁতেল তো আমার সাইকেল নিয়ে গেল। আবে শালা..
নিতু কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
- এবার কি হবে?
আমি কথার উত্তর দিতে যাব তখনই একটা টর্চ মুখে পড়ল। নিতুর পিতা আফজাল হোসেনের গলার মতন গলায় কেউ বলে উঠল,
- আরে এ তো মাইনুদ্দিন। তলে তলে এই কাজ। খাঁড়া মাইনুদ্দিনন্না! তোরে আজ হাতে পাই।
আমি কিছু না ভেবেই লুঙ্গি তুলে দৌড় লাগালাম। নিতুর ফোনের আগ্রহে লুঙ্গি পড়েই বাসা থেকে বের হয়ে ছিলাম। আমবাগানের উত্তর দিকের দেয়াল টপকে নিচে নামতে দিয়ে কাঁটাতারে লুঙ্গি আটকে গেল। সেই দিকে পাত্তা না দিয়ে হেঁচকা টান দিয়ে আবার দৌড় লাগালাম। পায়ে বাতাসের ঝাপটা লাগছে। কে জানে কতটুকু লুঙ্গি ছিঁড়ল। লুঙ্গি জলে যাক, আগে কোনমতে বেঁচে নেই।
কিছু দূর এগোতে গিয়েই রাতের আঁধারে গোবর না কিসে পাড়া দিয়ে আচমকা স্লিপ খেলাম। হাড়গোড় ভাঙল নাকি সন্দেহ। চিৎকার দিয়ে উঠলাম,
- ও মা...গো...
(পরিশেষে পরদিন সকালে বিচার কার্য সম্পন্ন হলো। সকল প্রমানের ভিত্তিতে জনমানবের সামনে আমায় কান ধরে উঠবস করানো হলো। মনে মনে ঠিক করে নিলাম, জীবনে আর রাতের নিম্নচাপে সাড়া দিব না।)
লেখা: সাফায়েত আহমেদ সাকিব