BoiPallab Group

রেল অথবা অপেক্ষা

 

রেল অথবা অপেক্ষা

পৃথিবীতে বিরক্ত বিষয়ক তালিকা করা হলে অপেক্ষা নামক জিনিসটি অবশ্যই সবার উপরে থাকা দরকার। তিন ঘন্টা ধরে ট্রেনের অপেক্ষায় বসে আছি কিন্তু ট্রেনের নেই হুঁশ। ট্রেন পৌঁছানোর সময় দুপুর দুটা বিশ। এখন বাজে তিনটা চৌত্রিশ। মোটামুটি এক ঘন্টা উপরে লেট। আগবাড়িয়ে তাড়াতাড়ি বের হওয়াটা ঠিক হয়নি। কে জানতো এরকম অস্থিকর মুহুর্ত ভাগ্যে জুটবে! এদিকে কন্ট্রোল রুম থেকে ঘোষণা দিয়েই যাচ্ছে ট্রেন আর কিছুক্ষনের মধ্যেই স্টেশনে পৌঁছাবে। আরে ব্যাটা তোদের কিছুক্ষনই যে এরকম জানলে আর ট্রেনের টিকিটই কাটতাম না। বুঝছে পারছি বিরক্তির সাথে খানিকটা রাগও শরীরে সঞ্চারিত হয়েছে।

অপেক্ষাগার থেকে বের হয়ে এখন এক চায়ের দোকান থেকে এককাপ চা নিয়ে দূরের এক বেঞ্চিতে বসে চুমুক দিচ্ছি। এরকম তপ্ত দুপুরে চা খাওয়াটা রীতিমতো খাপছাড়া বিষয় হলেও, রাগ কমানোর জন্য চা অপেক্ষা ভালো কিছু হতে পারে না। শরীরের রাগের উত্তাপ আর গরম চায়ের উত্তাপে বিরক্ত আর রাগ দুটোই কাটাকাটি। হঠাৎ পাশ থেকে বয়স্ক কন্ঠে কেউ বলে উঠল,

- বাবা, কারো জন্য অপেক্ষা করতেছ নাকি?

পাশ ফিরে তাকাতেই দেখি এক বৃদ্ধা আগ্রহ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বয়স কমছে কম হলেও ষাটোর্ধ হবে। চুলগুলো খানিকটা এলোমেলো, কিন্তু তার আগ্রহমুখের হাসিটা যে জগৎ এর সেরা হাসির মধ্যে একটা হবে এই নিয়ে সন্দেহ নেই। বুঝা যাচ্ছে যৌবনে অতি রূপবতী ছিলেন। কিন্তু এখন মুখমণ্ডলে ঢেকে আছে ভাজ পরা ছাপ! 

বিরক্তি জিনিসটা হালকা গুলিয়ে গেল ওনার বাবা ডাক শুনে। যদিও এখন কারো সাথেই কথা বলার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে আমার নেই, তবুও সৌজন্যসূচক ভাবে হলেও তার প্রশ্নের জবাব দেওয়া উচিত। আমি বিরক্তি ঢেকে হাসি মুখে বলার চেষ্টা করে বললাম,

- নাহ! কারো জন্য বসে নেই। বরং আমিই পরবর্তী ট্রেনে রওনা হবো।

মহিলা চোখের সামনের কিছু চুল কানের পিছে গুঁজে গিয়ে বলল,

- ওহ! আমার খোকন আজকে আসবে, তার জন্যই বসে আছি।

মনে মনে বললাম, আপনার ছেলে আসবে কি আসবে না তাতে আমার কিছুই যায়ে আসে না।  তবুও ভদ্রতার খাতিরে বললাম,

- ও আচ্ছা। 

মহিলা গালে হালকা চুলকে হাসি রেখে বলল,

- ছেলেটা চাকরির খোঁজে শহরে গিয়েছিল। এদিক সেদিক খোজাখুজির পর খোদার রহমতে শেষমেষ চাকরিটা পেয়েই গেল। 

বুঝতে পারছি মহিলা ছেলের চাকরি পাওয়ার গর্বটা না বলে ছাড়বে না। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা কথা শুরু করলে আর থামার নাম গন্ধ নাই। ইনিও বোধও সেই দলের একজন। কথা চালানোর ইচ্ছে না থাকলেও বললাম,

- তার চাকরিটা বুঝি অনেক দরকার ছিল তাই না?

- হ্যাঁ হ্যাঁ। অনেক দরকার ছিল। পরিবারে সে ছাড়া আমার কেউ নেই। বাড়ি ভাড়া আর ঋণের বোঝায় অতিষ্ঠ জীবন। পাওনা টাকা শোধ করতে উপায় না পেয়ে ছেলেকে শহরে পাঠানো চাকরির খোঁজে। শহরে নাকি চাকরির ভালো বাজার।

আমি বললাম,

- ও আচ্ছা। 

মহিলা আবার বলল,

- কিন্তু দেখো কান্ড! আজ রওনা হওয়ার আগে একবার ফোন দিয়েছিল আর দেয়নি। কিভাবে বুঝব সে আসতে আর কতক্ষন!

আমি বললাম,

- হয়ত উনি আপনাকে হঠাৎ এসে চমকে দিতে চাচ্ছেন।

মহিলা যেন আত্মা খুঁজে পেলেন আমার কথায়। 

- হ্যাঁ হ্যাঁ তাই হবে, তাই হবে। বলেই চুল চুলকাতে লাগলেন। এদিকে কন্ট্রোল রুম থেকে ভেসে আসল ট্রেন স্টেশনে পৌঁছাতে ৫ মিনিট সময় নিবে। দূর থেকেও ট্রেনের হুইসেল শুনতে পেলাম। যাক বাবা! শেষ পর্যন্ত ট্রেন আসল। মহিলাকে বললাম,

- আচ্ছা চাচী, আমি এখন চলে যাব। আমার ট্রেন এসে পড়েছে। আপনার সাথে কথা বলে ভালো লাগল (সৌজন্য বজায় রাখার জন্য বলা)। 

মহিলা বলল,

- আচ্ছা বাবা নিরাপদে যেও! 

- দোয়া করবেন।


চায়ের কাপটার দিকে তাকিয়ে দেখি চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। পুরোপুরি খেতে পারলাম না। মহিলার সাথে কথা বলার সময় চায়ের কথা মনেই ছিল না। কাপটা মুদির দোকানে দিতে এসে বললাম,

- তো কত টাকা?

দোকানদার দাম নিয়ে, বাকি টাকা ফেরত দিতে দিতে বলল, 

- মহিলার কথা বিশ্বাস না করাই ভালো। 

আমি আগ্রহে বললাম

- কেন?

- পাগল বেটি! গত ১ মাস ধরে ঐ বেঞ্চিতেই বসে আছে। তার নাকি ছেলে ফিরবে। কিন্তু এই এক মাসে কেউ ফিরল না। এক মাস আগে এই স্টেশনে আগমনকারী এক ট্রেনে আগুন লেগে দূর্ঘটনা হয়। হয়ত সেই ট্রেনেই উনার ছেলে ছিল। দূর্ঘটনায় মারা গেছে। কিন্তু ও তা বিশ্বাস করতেই চায় না। প্রতিদিনই নাকি তার ছেলে ফিরবে।

আমার মনে হঠাৎ আকাশ ভেঙে পড়ল। মহিলার সাথে অনিচ্ছাসূচক কথা বলাটা হয়ত ঠিক হইনি। আমি দোকানির দিকে তাকিয়ে  বললাম,

- ওহ! খুবই দুঃখজনক। 


ট্রেন স্টেশনে পৌঁছাল। কিন্তু যাওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার মধ্যে দেখা দিলো না। ইচ্ছে হচ্ছে মহিলার পাশে বসে খানিকক্ষণ কথা বলি। কিন্তু অনিচ্ছা সত্বেও ট্রেনের কেবিনে বসে, জানালার বাহিরে তাকিয়ে দেখলাম মহিলা এখনও বেঞ্চিতে বসে আছে। তার মুখে এখনও হাসির আভাস। কিন্তু দূর থেকে হলেও স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে তার চোখে লেগে আছে অপেক্ষার তীব্র ছায়া!

ওপাশ থেকে আমার মাও হয়ত আমার অপেক্ষায় বসে আছে, আমি কি পারব তার অপেক্ষার বাঁধ ভাঙতে? 


গল্প: রেল অথবা অপেক্ষা
লেখা: সাফায়েত আহমেদ সাকিব
শিক্ষার্থী, আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন