BoiPallab Group

যদ্যপি আমার গুরু - আহমদ ছফা

 

যদ্যপি আমার গুরু - আহমদ ছফা

প্রেক্ষাপটঃ
পিএইচডি করতে গিয়ে বিখ্যাত লেখক আহমদ ছফার সাথে দেখা হয় জাতীয় অধ্যক্ষ আব্দুর রাজ্জাকের। সেখান থেকেই শুরু হয় দুজনার সাখ্যতা। প্রায় এক যুগের প্রতি সপ্তাহে দেখা হত এই গুরু শিষ্যের। এই দীর্ঘদিন মেলামেশার ফলে আব্দুর রাজ্জাক স্যারকে নিয়েই লেখা আহমদ ছফার 'যদ্যপি আমার গুরু'। বইটিতে প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের, অর্থশাস্ত্র, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস, শিল্পী-সাহিত্য, ধর্ম-সংস্কৃতির দিক-দর্শন তুলে ধরেছেন আহমেদ ছফা।

কাহিনী সংক্ষেপঃ
আহমদ ছফার, 'যদ্যপি আমার গুরু' এমন একটি বই যা নিয়ে লিখতে বসলে লিখে শেষ করার মতো নয়। তাও বুক রিভিউ লেখার ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র!

দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.লিট প্রাপ্ত প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক, যিনি দাম্পত্য জীবনে চিরকুমার। বাংলা সাহিত্যের সাথে জড়িত অনেক ব্যক্তিবর্গের সাথে তাঁর ছিল ঘনিষ্ট সম্পর্ক। কথা বার্তায় আপাত মস্ত ঢাকাইয়া হলেও তাঁর মধ্যে ছিল আধুনিকতার ছোঁয়া এবং নতুনকে বরণ করার উচ্ছ্বাস। নিজে যেমন জ্ঞান অর্জন করতেন তেমনি জ্ঞান সাধনায় ব্রত হওয়ার প্রতি অন্যকেও অনুপ্রেরনা দিতেন। আর তারই বহিঃপ্রকাশ লেখকের কথায় যে— "প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের মত আমাকে অন্য কোনো জীবিত বা মৃত মানুষ অতো প্রভাবিত করতে পারেনি।" প্রফেসর সাহেব তাকে প্রচুর বই পড়তে বলতেন এবং নোট রাখতে বলতেন। তাঁর সুবিশাল লাইব্রেরির পুরাতন বইয়ের সুমিষ্ট সুবাস আহমদ ছফাকে আকৃষ্ট করত। সেখানে ছিল দেশি বিদেশি নানা বই। রাজনীতি, অর্থনীতি, পৌরনীতি, সাহিত্য, ডিকশনারি সবরকমের বই। অর্ডার দেয়া ডিকশনারির জন্য দিনের পর দিন তিনি বইয়ের দোকানে ধর্ণা দিয়ে থাকতেন। তার কথায় সমাজের লোকেরা কি ধরনের বই পড়ে তা দেখেই বোঝা যায় সমাজটা কোন পথে আছে বা কোন দিকে যাবে। জার্মান কবি গ্যোতের 'ফাউস্ট' এর অনুবাদ করার জন্য লেখকে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন আব্দুর রাজ্জাক স্যার। দুর্ভাগ্যবসত, কোনো প্রকাশক এই বই প্রকাশ করতে রাজি হন নি। অথচ তার গুরু প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক নিজেই জার্মান হাইকমিশনারের সাথে যোগাযোগ করে জার্মান খরচে 'ফাউস্ট’র অনুবাদ বইটি প্রকাশের ব্যবস্থা করে দেন।

আধুনিক বাংলা ভাষাকে তিনি প্রাকৃত ভাষা হিসেবে মানতে নারাজ। তাঁর মতে, বাংলার সাথে আরবী-ফারসী মিলে যে ভাষা হতো সেটাই ছিল আসল বাংলা ভাষা থেকে জোর করে আরবী ফারসী দুর করে সংস্কৃত শব্দের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এরই উদাহরণ হিসেবে ভারতচন্দ্রের লেখাকে উল্লেখ করেছেন। তিনি আরো বলেন, পড়াশুনা না জানলে আধুনিক বাংলায় কথা বলা যায় না। সাধারন লোকেরাই ভাষার স্তর নির্মাতা, সাহিত্যিকরা নন। মানুষ কথা বলে বলেই সাহিত্য রচিত হয়। যেমন, ল্যাটিন ভাষায় কেউ কথা বলেনা তাই ল্যাটিন ভাষায় কেউ সাহিত্য লেখে না। রবি ঠাকুরের গান তার ভাল লাগলেও ভাষার স্তর নির্মানে রবি ঠাকুরের কোনো হাত আছে বলে তিনি মনে করতেন না। অন্যদিকে সাহিত্যিক হিসেবে রবি ঠাকুরকে সমর্থন করলেও, মানুষ হিসেবে বিদ্যাসাগরই ছিল তাঁর কাছে বড়। বঙ্কিমকে নিয়ে তিনি বলেন, বঙ্কিমের পড়াশুনা হয়েছিল মুসলমানদের টাকায়। আর বঙ্কিম এমন কড়া কথার ঋণ শোধ করেন মুসলিম ফান্ডের টাকায় পড়াশুনা করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কলম ধরে। এছাড়াও তিনি মনে করতেন রাজা রামমোহন রায় ধর্ম প্রচারের চাইতে সাহিত্যের সেবায় শ্রেষ্ঠ। পাঠকের গ্রহনযোগ্যতার দিক বিবেচনা করে পুঁথিসাহিত্যকে তিনি নেতিবাচক ভাবে দেখেন নি বরং এর ইতিবাচক ভাব ব্যক্ত করেছেন। বইটিতে কাজী মোতাহের হোসেন, শেখ মুজিব প্রমুখ ব্যক্তিদের নিয়ে কথা হয়েছে গুরু শিষ্যের। পাঠকদের পরিচয় করে দেয়া হয়েছে নানান বইয়ের সাথে।

প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক রাজনীতি বিদ্বেষী ছিলেন না, ছিলেন রাজনীতি সচেতন। একই সাথে ছিলেন সংস্কৃতি ও ধর্ম সচেতন। দেশ ভাগ হওয়ার আগে তিনি ছিলেন মুসলিমলীগের সমর্থক। লন্ডনে তিনি হ্যরল্ড লাস্কির এক কথার প্রতিউত্তরে বলেছিলেন, “আই এম এ মেম্বার অব মুসলিম লীগ এন্ড ফলোয়ার অব মিস্টার জিন্নাহ।” ‘কেনো আমি পাকিস্তান চেয়েছিলাম’ শিরোনামে ইসলামী একাডেমিতে বক্তৃতায় তিনি দুই বাংলার সাহিত্যে ব্যবহৃত চরিত্রগুলোর মধ্যে হিন্দু ও মুসলিম চরিত্রের অনুপাত করেছেন। তাঁর পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষে থাকার অনেক কারণের একটা ছিল সাহিত্যে মুসলমানদের প্রাধান্য না দেয়া। ধর্ম নিয়ে তিনি বলেন জন্মান্তরবাদের ছিঁটাফোঁটাও নাই। এটা হিন্দু সমাজ দ্রাবিড়দের কাছ থেকে ধার করে একটা প্রথা হিসেবে চালিয়ে যাচ্ছে। বাইবেল মৃত্যুপরবর্তী জীবন নিয়ে অনেক কথা বললেও ইসলামের মত পার্থিব জীবন নিয়েও তেমন কিছু বলেনি। যেখানে ইসলাম ‘ফিদ্দুনিয়া ওয়াল আখেরাত’ এর কথা বলে দুনিয়া ও আখেরাতের মধ্যে একটা ভারসাম্যমূলক বক্তব্য দিয়েছে।

চিত্রকলার প্রতি ছিল আবদুর রাজ্জাক অঘাদ ভালবাসা ও দুর্বলতা। চিত্রশীল্পি জয়নুল আবেদিন ও এস এম সুলতানের চিত্রকর্ম তার কাছে সমাদৃত। জয়নুলের ‘পালকি’ চিত্রকর্মের বেয়ারাদের সঠিক ব্যবহারের জন্য তিনি জয়নুলের সুনাম করেছেন। এস এম সুলতানের গাঁজা খাওয়ার কথা জেনেও নিজের বাসায় সুলতানকে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। তিনি নিজের জমানো টাকা খরচ করে এস এম সুলতানের চিত্রকর্মগুলোকে বাঁচিয়েছেন।

পাঠক প্রতিক্রিয়াঃ
যতক্ষন বইটি পড়ছিলাম ততক্ষন মনে হচ্ছিল জ্ঞানসমুদ্রে ডুবে ছিলাম। রিভিউটা লিখে মনে হচ্ছে বিশাল তথ্যসমৃদ্ধ এই ‘যদ্যপি আমার গুরু’ বইটির একবিন্দুও হয়ত আমি এখানে তুলে ধরতে করতে পারিনি। লেখক তাঁর গুরুর উচ্চারিত বাক্য কেবল প্রতিধ্বনিত করেন নি, ব্যাখ্যা করেছেন, উপযুক্ত পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপন করেছেন, প্রয়োজনে প্রতিবাদও করেছেন। আহমদ ছফা প্রফেসর রাজ্জাকের ওপর খোলামেলা তীক্ষ, গভীর এবং সরস এমন একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন যা একমাত্র তার পক্ষেই সম্ভব।

পছন্দের কিছু উক্তিঃ
১. বাংলার ভবিষ্যত সম্পর্কে আমি আর কি কমু। সে তগো উপর।
২. যে ধরনের কাজে অমানুষিক মানসিক শ্রমের প্রয়ােজন হয়, সে ধরনের কাজ করার প্রেরণা আমাদের সমাজ থেকে সংগ্রহ করা একরকম অসম্ভব। এখানে একজন বড় কাজ করলে উৎসাহ দেয়ার জন্য কেউ এগিয়ে আসে না।
৩. আমাদের শ্রদ্ধাভাজন বয়ােজ্যেষ্ঠরা যেভাবে আমাদের উপকার করতে চান আমরা পরবর্তী প্রজন্মের তরুণরা যেভাবে উপকৃত হতে চাই, তার মধ্যে বিস্তর ফারাক, সেদিন খুব ভালােভাবে বুঝতে পেরেছিলাম।
৪. পড়ার কাজটি অইল অন্যরকম। আপনে যখন মনে করলেন, কোনো বই পইড়্যা ফেলাইলেন, নিজেরে জিগাইবেন যে বইটা পড়ছেন, নিজের ভাষায় বইটা আবার লিখতে পারবেন কিনা। আপনের ভাষার জোর লেখকের মতো শক্তিশালী না অইতে পারে, আপনের শব্দভান্ডার সামান্য অইতে পারে, তথাপি যদি মনে মনে আসল জিনিসটা রিপ্রোডিউস না করবার পারেন ধইর‍্যা নিবেন, আপনের পড়া অয় নাই।


বই: যদ্যপি আমার গুরু 
লেখক: আহমদ ছফা
প্রকাশনী: মাওলা ব্রাদার্স 
মূল্য: ১৭৫ টাকা 
পৃষ্ঠা: ১১০ পৃষ্ঠা 

বই পর্যালোচক: রিজয়না কামাল 
শিক্ষার্থী, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন