BoiPallab Group

দ্য বাটারফ্লাই ইফেক্ট

দ্য বাটারফ্লাই ইফেক্ট

 ‘দ্য বাটারফ্লাই ইফেক্ট’

নামটি শুনে মনে হতে পারে প্রজাপতির বিষয়ে হয়তো কোনো আলোচনা। কিন্তু বিষয়টি একদমই তেমন কিছু নয়। এই বিষয়টি সম্পর্কে জানার আগে আপনার সম্পর্কে কিছু বিস্ময়কর তথ্য দিয়ে নি। হ্যা, অবাক হওয়ার কিছু নেই। আপনার সম্পর্কেই তথ্য।

আপনি কি জানেন আপনি এক সেকেন্ডের জন্য নিঃশ্বাস না নিলে জাপানের কানসাই অঞ্চলের সাতো্মি অসুস্থ হয়ে পড়বে? অবাক হচ্ছেন? 

আপনি কি জানেন, যে আপনার বাবার কাজের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ মনোভাব থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে জামাইকা-এর উসাইন বোল্ট তার ক্যারিয়ারকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে? এখন হয়তো বলবেন আমি পাগল হয়ে গিয়েছি কিনা? 

আশ্চর্য হয়ে যাওয়ার কিছুই নেই। উপরোক্ত ঘটনাগুলো কাল্পনিক। তবে এই কথাটি সত্য যে এই পৃথিবীর শতভাগ মানুষ একে অপরের কাজ দ্বারা কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত। এই তত্ত্বটি হলো ‘বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব’ বা ‘Theory of Chaos”(থিওরি অফ ক্যাওস) যার একটি ফল হলো বাটারফ্লাই ইফেক্ট (The Butterfly Effect)। তাই উপরের ঘটনাগুলো সত্য হয়েও যেতে পারে। 

এই তত্ত্বটির ভিত্তি হলো যে কোনো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কাজ, কোনো ঘটনার শেষ পরিণতিকে বা ফলাফলকে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন করতে পারে। ‘বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব’ বা "Theory of Chaos" (থিওরি অফ ক্যাওস) নিয়ে প্রথম কোনো ধারণা প্রকাশ করা হয় ১৯৮০ এর দশকে। তবে এ বিষয়ে প্রথম যিনি সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিতে পেরেছেন তিনি হলেন মার্কিন গণিতবিদ এডওয়ার্ড নর্টন লরেঞ্জ (Edward Norton Lorenz) তিনি MIT এর অধ্যাপক হিসেবেও কর্মরত ছিলেন।

American Association for Advancement & Science (AAAS) এর ১৩৯ তম অধিবেশনে গণিতবিদ এবং আবহাওয়াবিদ সকলের নিকট একটি প্রশ্ন তুলে ধরেন। তাঁর প্রশ্নটি ছিল ব্রাজিলে যদি কোনো প্রজাপতি তার ডানা ঝাপটায় তাহলে ফলাফলস্বরূপ যুক্তরাষ্টের টেক্সাসে টর্নেডো হতে পারে কি? উপস্থিত অনেকেই তখন লরেঞ্জ-কে পাগল ভেবেছিলেন। এডওয়ার্ড নর্টন লরেঞ্জ গাণিতিকভাবে প্রমাণ করে দেখান যে বিশ্বের যেকোনো তরঙ্গকে সামান্য পরিবর্তন করা হলে সেই তরঙ্গ পৃথিবীর অন্য সকল তরঙ্গকে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন করতে পারে। এ বিষয়টি তরঙ্গের উপরিপাতন (Superposition of wave) দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়। অধিবেশনের প্রশ্নটি তিনি উদাহরণস্বরূপ করেছিলেন। তবে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে যেকোনো ক্ষুদ্রকাজ যা আপাত দৃষ্টিতে গুরুত্বহীন মনে হতে পারে তবে তার পরিণতি বা ফলাফল অনেক বড় কোনো পরিবর্তন সাধন করতে পারে। মূলত সেই অধিবেশনের প্রশ্ন থেকেই এই তত্ত্বটিকে ‘বাটারফ্লাই ইফেক্ট’ বা প্রজাপতি প্রভাব বলা হয়ে থাকে। 

এখন আসুন ‘বাটারফ্লাই ইফেক্ট’ নিয়ে একটি সত্য ঘটনা জেনে নেয়া যাক। 

এই ঘটনাটিকে অনেকেই ভুল দয়া কিংবা Wrong Mercy বলে থাকে। তবে এটিকে ‘বাটারফ্লাই ইফেক্ট’-এর সবচেয়ে বড় এবং জনপ্রিয় উদাহরণ হিসেবে ধরা হয়। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। দিনটি ছিল ২৮শে সেপ্টেম্বর, ১৯১৮ সাল। সেদিন ব্রিটেন এবং জার্মানির মুখোমুখি যুদ্ধের একটি পর্যায়ে হেনরি টেন্ডেন নামক একজন ব্রিটিশ সৈনিকের বন্দুকের নিশানায় আহত হয়ে পড়েন একজন জার্মান সৈনিক। হেনরি টেন্ডেন সেদিন কিন্তু চাইলেই সেই আহত জার্মান সৈনিক কে গুলি করে তার প্রাণনাশ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেই আহত সৈ্নিক এর উপর দয়া করে চলে যান এবং পরবর্তীতে সেই জার্মান সৈ্নিক চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু আমরা কি জানি সেই দয়াগ্রস্থ সৈ্নটি কে ছিলেন? তিনিই হলেন বিখ্যাত এডলফ হিটলার।

একবার চিন্তা করে দেখুন সেদিন যদি জার্মান সৈনিকটির প্রতি দয়া করা না হতো তাহলে কি আদৌ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংগঠিত হতো? পারমানবিক বোমাই কি আবিস্কার হতে পারত? এই প্রশ্নগুলো্র উত্তর হয়তো কেউই জানেন না কিংবা দিতে পারবেন না। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রকৃ্ত অর্থেই পুরো বিশ্বের উপর প্রভাব ফেলেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে কিন্তু পুরো ইউরোপেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার শোচনীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল এবং সেই শো্চনীয় অবস্থার করাল গ্রাস থেকে মুক্তি পায়নি তখনকার অন্যতম ধনী দেশ ব্রিটেন-ও। এই অর্থনৈ্তিক টানাপোড়নের ফলশ্রুতিতে দীর্ঘদিন ধরে উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে ব্রিটিশ সরকার পূর্বের মতন আর সামাল দিতে পারছিল না। যার ফলে জন্ম হয় ভারত,পাকিস্তান এবং কালের পরিক্রমায় বাংলাদেশের। এখন প্রশ্ন থেকে যায় সেদিন যদি হেনরি টেন্ডেন হিটলারের প্রতি দয়া না দেখাতেন তাহলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কি এত মানুষের মৃত্যু ঘটত? কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নাহলে উপমহাদেশ স্বাধীন হয়ে পরবর্তীতে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা পেত? আমরা কি ঠিক এই মুহুর্তে এত অবাধ, সুন্দর এবং এত সহজভাবে বাংলায় এই আর্টিকেলটি পড়ে এই বিস্ময়কর ঘটনাটি সম্পর্কে জানতে পারতাম? জানতে পারলেও ঘটনা কিংবা ইতিহাস কি এমনই থাকত? এমনি অসীম প্রশ্নের অজানার ধোয়াশায় আমরা ভেসে বেড়াচ্ছি। 

এভাবেই অনেক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কাজ আমাদের ভবিষ্যৎ এবং সভ্যতাকে প্রভাবিত করতে পারে। আর এটিই হচ্ছে ‘বাটারফ্লাই ইফেক্ট’। 

Founding Father of the United States খ্যাত কবি বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন (Benjamin Franklin) ‘বাটারফ্লাই ইফেক্ট’ কে একটু কবিত্ব দিয়ে বর্ণনা দিয়েছিলেন। তাঁর বর্ণনাটি ছিল এমন, 

“একটি পেরেকের অভাবে জুতা ব্যবহার হলো না
জুতার অভাবে ঘোড়া চলতে পারল না
ঘোড়ার অভাবে ঘোড়ার সহিসও থাকলো না
সহিসের অভাবে যুদ্ধে জেতা গেলো না
যুদ্ধে হারার কারণে হারিয়ে গেলো রাজত্ব” 

একটি বিশাল রাজত্ব হারিয়ে গেল শুধুমাত্র একটি তুচ্ছ পেরেকের অভাবে। তাই মনে রাখবেন আপনি যেমন কারো কাজের দ্বারা প্রভাবিত একইভাবে আপনিও কিন্তু কারো না কারো না প্রভাবক। তাই নিজের অবস্থান কিংবা কাজকে তুচ্ছ করে দেখার কিছুই নেই। কারণ আপনার দ্বারা করা কোনো তুচ্ছ কাজ যা কিনা নিছক অবহেলা করার পাত্র, সেই কাজটি হয়তো কোনো একদিন সভ্যতার অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করতে পারে। তাই সবসময় নিজের সেরাটা দিয়েই যেকোনো কাজ করা উচিত। যাতে আপনার কাজের কাল্পনিক প্রজাপতির ডানা ঝাপটানো টর্নেডো সৃষ্টি করার মতন বড় কোনো প্রভাব রাখতে পারে যেকোনো স্তরে। 

লেখা: শেখ রাহাত সিদ্দিকী

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন